
পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিদেশ যাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে পরিচয় গোপন করে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়ে পরিবেশ অধিদফতরের আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে চাকরি করছেন রোহিঙ্গা যুবক আব্দুল আজিজ।
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, আব্দুল আজিজ বর্তমানে সেন্টমার্টিন বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির কর্মী। পাশাপাশি জেলা পরিবেশ অধিদফতরের মেরিন পার্কের আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজিজকে এনআইডি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য (মেম্বার) আব্দুর রউফ। তবে তাকে এনআইডি করতে সহযোগিতা করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আব্দুর রউফ। তিনি বলেন, ‘কীভাবে আজিজ এনআইডি করেছে, তা আমি জানি না। আমি কোনও সহযোগিতা করিনি। হয়তো টাকা দিয়ে দালালদের মাধ্যমে এনআইডি করেছে।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল আজিজ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক মো. আব্দুলের ছেলে। ১৯৯২ সালে স্ত্রীকে নিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন আব্দুল। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হয়। তখন ছেলে আজিজের বয়স ছয় বছর। ২০০১ সালের দিকে আব্দুলের স্ত্রীকে বিয়ে করেন সেন্টমার্টিনের কোনপাড়া এলাকার বাসিন্দা আলী আহমদ। ২০১৭ সালে আলী আহমদকে বাবা এবং তার স্ত্রী নুর নাহারকে মা দেখিয়ে জন্ম নিবন্ধন তৈরি করেন। ওই বছরই এনআইডি করেছেন।
এনআইডিতে জন্মসাল উল্লেখ করেছেন ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি; অর্থাৎ যে বছর তার বাবা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। প্রকৃতপক্ষে সেটি তার বয়স নয় এবং আলী আহমদ বাবা নন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আলী আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আজিজের বাবা আব্দুল মারা যাওয়ার এক বছর পর ২০০১ সালে তার মা নুর নাহারকে আমি বিয়ে করি। তখন আজিজের বয়স সাত বছর হবে। আজিজ আমার ছেলে নয়, মূলত মিয়ানমারের নাগরিক আব্দুলের ছেলে। দালাল চক্রের সঙ্গে মিলে আমাকে বাবা বানিয়ে এনআইডি করেছে বলে শুনেছি। তবে কারা কীভাবে করে দিয়েছে, সেটি আমি জানি না।’
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিচ কর্মীরা জানিয়েছেন, পরিচয় গোপন করে রোহিঙ্গা নাগরিকরা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। যা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
সেন্টমার্টিনের কোনপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসেম বলেন, ‘আজিজ রোহিঙ্গা নাগরিক। কিন্তু সে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় এনআইডি বানিয়ে এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে।’
আজিজের বিরুদ্ধে সড়ক নির্মাণকাজে চাঁদা দাবির অভিযোগ
পরিবেশ অধিদফতর জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছিল। এ ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বীপের প্রতিবেশব্যবস্থা রক্ষা করা। কারণ দ্বীপটির ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন হলে তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে পারে এবং দ্বীপটি বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এরপর পরিবেশ অধিদফতর দ্বীপে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। তখন থেকে তাদের কার্যক্রম ঢিলেঢালাভাবে চললেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর থেকে সেন্টমার্টিনকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। সে সুবাদে পরিবেশ ও বিচ কর্মীদের গুরুত্ব বেড়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আত্ততায় সেন্টমার্টিনের গলাচিপা থেকে এসকেডি (দক্ষিণপাড়া) পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ পায় এফএক্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সড়ক নির্মাণকালে সম্প্রতি পরিবেশ অধিদফতরের কর্মী পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারের কাছে চাঁদা হিসেবে ‘সিমেন্ট-তেল’ দাবি করেন আজিজ।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফএক্স-এর ব্যবস্থাপক বসন্ত দে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে সড়ক নির্মাণকাজ দেখতে এসেছিলেন আজিজ। তখন বলেছিলেন পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করবো না, বিনিময়ে চাঁদা হিসেবে সিমেন্ট ও তেলসহ ১০০ বস্তা বালু দিতে হবে। তাকে বুঝিয়ে কাজ শেষে দেওয়া হবে বলেছি। এরপরও লোকজন নিয়ে এসে ঝামেলা করার চেষ্টা করছেন।’
দুই বিভাগে চাকরি করায় বরখাস্ত হয়েছিলেন আজিজ
জেলা প্রশাসন ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অধীনে সেন্টমার্টিনে বিচ কর্মীর পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরের মেরিন পার্কে আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে কাজ করেন আজিজ। যেটি চাকরির বিধি পরিপন্থি। এ কারণ দেখিয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় আজিজকে সাময়িক চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিল। পাঁচ-ছয় মাস পর পরিবেশ অধিদফতরে চাকরি করবে না মর্মে অঙ্গীকার দিয়ে বিচ কর্মী হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই আবারও পরিবেশ অধিদফতরের কাজে জড়িয়ে পড়েন। যা চাকরি বিধি পরিপন্থি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল আজিজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সড়ক নির্মাণের কাজে আমি কারও কাছ থেকে চাঁদা দাবি করিনি। এ ছাড়া সঠিক তথ্য এবং কাগজপত্র দিয়ে এনআইডি কার্ড বানিয়েছি। আমাদের মধ্যে একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তবে আলী আহমদ আমার প্রকৃত বাবা নন, এটা সত্য।’
পরিচয় গোপন করে রোহিঙ্গা যুবকের এনআইডি করার বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভূল তথ্য দিয়ে এনআইডি তৈরি অপরাধ। পাশাপাশি চাঁদা দাবির বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা বলেন, ‘আব্দুল আজিজ আমাদের দফতরে আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে সেন্টমার্টিন বিচে কাজ করেন। এটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তিনি রোহিঙ্গা যুবক এমন অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম বলেন, ‘আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ শুনেছি। আবার রোহিঙ্গা যুবক এটিও শুনেছি। তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন

পাঠকের মতামত